মুরজিয়াহ বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত

Posted by Akash on Wednesday, April 9, 2025

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

মুরজিয়াহ বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত

মূল: আল্লামা ইউসুফ গোন্দাল্বি (রহঃ)
উৎস: দাস্তানে হানাফিয়াহ


মুরজিয়াহদের নিকট ঈমানের সংজ্ঞা

হযরত ফুদাইল ইবনে ইয়াদ (রহঃ) বলেন:

“إِنَّ أَهْلَ الْإِرْجَاءِ يَقُولُونَ: إِنَّ الْإِيمَانَ قَوْلٌ بِلَا عَمِلٍ”

অর্থ: মুরজিয়ারা বলে ঈমান হচ্ছে শুধু ক্বওল (মৌখিক স্বীকৃতি), আমল তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।

মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহঃ) বলেন : মুরজিয়াহ হচ্ছে তারা যারা আমল কে (ঈমান থেকে) আলাদা রাখেন অথবা এই আশা রাখেন যে ঈমানের সাথে গুনাহ ও অন্যায় কোনো ক্ষতি করে না । । সুতরাং মূর্জিয়াদের চিন্তায় সিদ্দিকগণের ঈমান ও অন্য লোকের ঈমান সমান।

ইমাম আহমাদ বিন হানবাল (রহঃ) বলেন : মুরজিয়াহদের নিকট ঈমান হলো আমল ব্যতীত শুধু ক্বওলের (মৌখিক স্বীকৃতি) নাম । ঈমানের সাক্ষী শুধু মুখেই যথেষ্ট । সকল মানুষের ঈমান সমান । সাধারণ মানুষের ঈমান ও ফেরেশতা এবং নবীদের ঈমান সমান । আর না ঈমান বাড়ে না কমে । তারা ঈমানের জন্য ইনশাআল্লাহ বলা সঠিক মনে করেন না । (তারা মনে করেন) যে শুধু মুখেই ঈমানের কথা বলল কিন্তু আমলের আশে পাশেও গেলো না সেও পাক্কা ঈমানদার

ইমাম আহমাদের উল্লেখিত সঙ্ঘা থেকে তাদের ব্যাপারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সামনে আসে

  • তাদের মতে ঈমান শুধু কথার নাম ।
  • তাদের মতে সমস্ত মুসলমানের ঈমান সমান ।
  • এবং সমস্ত মুসলমানদের ঈমান ফেরেশতা ও নবীদের মত ।
  • তাদের মতে ঈমানের জন্যে ইনশাআল্লাহ বলা সঠিক নয় ।
  • ঈমান কমেও না বাড়েও না

আহলে সুন্নাহর নিকট ঈমানের সংজ্ঞা

ইমাম বাগাবী (র:) বলেন :

اتفقت الصحابة والتابعون، فمن بعدهم من علماء السنة على أن الأعمال من الإيمان وقالوا: إن الإيمان قول وعمل وعقيدة، يزيد بالطاعة

সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ও তাবিইন কেরাম (র:) এবং তাদের পরের আহলে সুন্নাতের ইমামগন এই বিষয়ে একমত যে আমল ঈমানের থেকে । ঈমান হল ক্বওল(মৌখিক স্বীকৃতি), কাজ , ও আকীদার নাম । যা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে বাড়ে এবং গুনাহ ও নাফরমানীর কারণে কমে

ইমাম আহমাদ বিন হানবাল (রহঃ) বলেন : ঈমান হল ক্বওল ও আমলের নাম যা বাড়তে থাকে কিন্তু যেনা , মাদকসেবন এর কারণে কমে যায়

ইমামুল মুহাদ্দিসীন আমিরুল মু’মিনিন ফিল হাদিস ইমাম বুখারী (র:) বলেন :

وَهُوَ قَوْلٌ وَفِعْلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ

এবং তা (ঈমান ) হল ক্বওল ও আমলের নাম যা বাড়ে ও কমে


মুরজিয়াহ ও আহলে সুন্নাহর মধ্যে ইখতিলাফ

আপনার সামনে মুরজিয়াহদের আকীদা ও আহলে সুন্নাতের আকীদা পেশ করা হল । যার মাধ্যমে আপনি দুই দলের ইখতিলাফের ব্যপারে জানলেন ।

আহলে সুন্নাহর ইমাম সুফিয়ান আস সাওরি (রঃ) এই ইখতিলাফ সম্পরকে বলেন :

خَالَفَتْنَا الْمُرْجِئَةُ فِي ثَلَاثٍ: نَحْنُ نَقُولُ: الْإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ , وَهُمْ يَقُولُونَ: الْإِيمَانُ قَوْلٌ بِلَا عَمَلٍ , وَنَحْنُ نَقُولُ: يَزِيدُ وَيَنْقُصُ , وَهُمْ يَقُولُونَ: لَا يَزِيدُ وَلَا يَنْقُصُ , وَنَحْنُ نَقُولُ: نَحْنُ مُؤْمِنُونَ بِالْإِقْرَارِ , وَهُمْ يَقُولُونَ: نَحْنُ مُؤْمِنُونَ عِنْدَ اللهِ

মুরজিয়ারা আমাদের (আহলুস সুন্নাহ) সাথে ইখতিলাফ করে । আমরা বলি ঈমান হল ক্কওল ও আমল তারা বলে ঈমান শুধু আমল ব্যতিত কওলের নাম । আমরা বলি তা বাড়ে ও কমে তারা বলে ঈমান বাড়েও না কমেও না । আমরা আহলে সুন্নাতরা বলি “আমরা ইকরারের (স্বীকারোক্তি) সাথে মু”মিন , তারা বলে আমরা ঈন্দাল্লাহ (আল্লাহর কাছে) মু’মিন ।

ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ (রঃ) বলেন ; আমরা আহলে সুন্নাহরা বলি যে ঈমান হল কওল ও আমল । কিন্তু মুরজিয়াহরা বলেন ঈমান হচ্ছে শুধু কওল । এবং তারা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজিব মনে করেন যে লা ইলাহা ইল্লাহুর স্বীকারোক্তি দিয়েছে যদিও সে ফরজ তরককারী হয়

হযরত ফুদাইল ইবনে ইয়াদ (র:) আহলে সুন্নাত ও মুরজিয়াদের ইখতিলাফের ব্যপারে গভীরভাবে আলোকপাত করেন যার সারসংক্ষেপ হচ্চে

আহলে বেদআতরা (মুরজিয়াহ) বলেন ঈমান হচ্ছে আমল ব্যতিতশুধু স্বীকারোক্তি আর ঈমান একটিই । (তারা আরও বলে) মানুষের মধ্যে ঈমানের কোন পার্থক্য নাই বরং শুধু আমলের পার্থক্য আছে । যেই ব্যক্তিই মুরজিয়াহদের এই চিন্তাধারনা পোষণ করে সে রাসুল (ছাঃ) এর হাদিসের বিরোধিতা করে । এটা এই কারনে যে রাসুল (ছা;) বলেছেন ঈমানের সত্তরটির উপর শাখা আছে যার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া এবং হায়া (লজ্জা) ঈমানের একটি শাখা যেই বলে ঈমানের মধ্যে পার্থক্য নাই (অর্থাৎ ঈমান কমে না বাড়ে না বলে ) তার অর্থ এই হলো যে ফরজসমূহ (নামাজ ,যাকাত , রোজা , হাজ্জ ) ঈমানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয় । তাই ঐ বেদাতিরা (মুরজিয়ারা) আমলকে ঈমানের থেকে আলদা করে নিয়েছে । এবং প্রকাশ্য ভাবে বলে যে ফারায়েজ ঈমানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয় । যারই চিন্তাধারনা এরকম সে অনেক বড় মিথ্যা বলেছে । আমার ভয় হয় ফারায়েযের এই অস্বীকারের কোন একপর্যায়ে না তারা আল্লাহর হুকুমেরই বিরোধিতা করে বসে । আহলে সুন্নাহরা বলেন আল্লাহ সুবাহ্ নাহু ওতাআলা আমলকে ঈমানের সাথে জুড়ে দিয়েছেন ফারায়েয ও নিঃসন্দেহে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত । আহলে সুন্নাহরা আরও বলেন আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ আমলকে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত করেছেন কিন্তু মুরজিয়াহরা বলেন আমল ঈমানের থেকে আলাদা ।

উপরোক্ত ইমামুল আযমদের দেওয়া বৈশিষ্ট্যর মাধ্যমে আহলে সুন্নাহ ও মুরজিয়াহদের মধ্যে পার্থক্য জানা যায় ।


হক কোনটি?

এই মাসালায়ও হক আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সাথে। আর তাহলো ঈমান কওল ও আমলের নাম যা আল্লাহর আনুগত্যে বৃদ্ধি পায় ও আল্লাহর নাফরমানিতে হ্রাস পায় । ঈমান বৃদ্ধির দলিল কুরআনের অনেক জায়গায় রয়েছে যেমন

মহান রাব্বুল আলামিন বলেন:

وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا

আর তাদের কাছে যখন তাঁর আয়াত পঠিত হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে (আনফাল ২)

অন্যত্র বলেন:

وَ یَزۡدَادَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِیۡمَانًا

“আর মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায়।” (আল-মুদ্দাসসির: ৩১)

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

هُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ السَّکِیۡنَۃَ فِیۡ قُلُوۡبِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ لِیَزۡدَادُوۡۤا اِیۡمَانًا مَّعَ اِیۡمَانِهِمۡ ؕ

তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেছিলেন যেন তাদের ঈমানের সাথে ঈমান বৃদ্ধি পায় (আল-ফাতহ ৪)

আরও বলেন:

وَ یَزِیۡدُ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اهۡتَدَوۡا هُدًی

আর যারা সঠিক পথে চলে আল্লাহ তাদের হিদায়াত বৃদ্ধি করেন ( মারইয়াম ৭৬)

অন্যত্র বলেন:

وَ الَّذِیۡنَ اهۡتَدَوۡا زَادَهُمۡ هُدًی وَّ اٰتٰهُمۡ تَقۡوٰىهُمۡ

আর যারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে আল্লাহ তাদের হিদায়াত প্রাপ্তি আরো বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাদের তাকওয়া প্রদান করেন (মুহাম্মাদ ১৭)

উপরক্ত আয়াতের মাধ্যমে এই বিষয় পরিষ্কার যে আল্লাহর আনুগত্যে ঈমান বৃদ্ধি পায় ।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈমানের ষাটেরও অধিক শাখা আছে। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি শাখা। (মুসলিম ১/১২ হাঃ ৩৫, আহমাদ ৯৩৭২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৮)

এই হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে ঈমানের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শাখা রয়েছে। এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে ।