ফিকহুল হাদিস সাহু সেজদার অধ্যায়

Posted by Akash on Saturday, April 6, 2024

ইমরান আয়্যুব লাহোরি (হাফি) এর লিখিত ফিকহুল হাদিসের অনুবাদ

আভিধানিক অর্থ –

سهو ভুলে যাওয়া বা কোন বিষয়ে অমনোযোগী হওয়া বা অন্য দিকে মন চলে যাওয়া অর্থে ব্যবহিত হয় ।

ইবনে হাজার (রঃ) বলেন – سهو কোন বিষয়ে অমনোযোগী হওয়া এবং অন্য মনস্ক হয়ে যাওয়া কে বলা হয় , এবং কেহ কেহ  سهو আর نسيان এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন  যা কোন গুরুত্ব রাখে না ।

আল্লামা আঈনী (রঃ) বলেন – উভয়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে আর তাহলো – سهو তে মানুষের চেতনা সম্পুরনভাবে হারিয়ে যায় কিন্তু نسيان এ কিছু চেতনা অবশিষ্ট থাকে ।

পারিভাষিক অর্থ

সেজদাতুল সাহু ঐ দুই সেজদাকে বলা হয় যা নামাজে ভুলে কম বেশি করার জন্য আদায় করা হয় ।

যেহেতু নাবী (সাঃ) একজন মানুষ ছিলেন এবং মানুষ হিসেবে তিনিও মাঝে মধ্যে নামাজে ভুলে জান , যেমনটি রাসুল (সাঃ) নিজেই বলেছেন –

إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ أَنْسَى كَمَا تَنْسَوْنَ فَإِذَا نَسِيتُ فَذَكِّرُونِي
আমি তোমাদের মতোই মানুষ। আমিও ভুল করি যেমন তোমরা ভুল করো।  আমি কোন সময় ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। ( বুখারী হাঃ ৩০১)

তাই ভুল ও অমনোযোগী হওয়ার কারনে নামাজের মধ্যে যে  ক্রুতি – বিচ্যুতি দেখা দেয় তা পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ তা’আলা সেজদা সাহুকে জায়েয করেছেন যা রাসুল (সাঃ) নিজের কাজ ও কথার মাধ্যমে উম্মতের কাছে পোছিয়েছেন । নাবী (সাঃ) বলেন –

لِكُلِّ سَهْوٍ سَجْدَتَانِ
প্রত্যেক সাহুর জন্য দুই সেজদা ( ইবনে মাজাহ ১২১৯ (হাসান)

সাহু সেজদার হুকুম –

এই বিষয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন  ।

  • আহনাফের মতে – সেজদা সাহু ওয়াজিব  ।
  • শাফী , মালিকি , হানবালীদের মতে – সুন্নাত ও মুস্তাহাব ।
  • ইবনে হাজামের মতে – নামজের মধ্যে প্রত্যেক কম বেশিতে এই সেজদা ওয়াজিব ।
যারা ওয়াজিব বলেন তারা এই হাদিসগুলো থেকে দলিল নিয়েছেন –
  • إِذَا شَك …….. فَلْيَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ (তোমাদের কারো ভুল হয়ে গেলে সে যেন দু’টি সিজদা করে) ( মুসলিম ৫৭২)
  • إِذَا زَادَ الرَّجُلُ أَوْ نَقَصَ فَلْيَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ ( যখন কোন ব্যাক্তি (সালাতে) কিছু বেশী কিংবা কম করবে, তখন দুটি সিজদা (সাহু) করে নিবে) ( মুসলিম ১১৬৫)

সাহু কখন করবে সেজদার আগে না পরে এই বিষয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন

  • আহনাফদের মতে – প্রত্যেক সাহু সালামের পরে করতে হবে । ইমাম নাখায়ী , ইমাম সাওরি ইমাম হাসান এবং হযরত উমর বিন আব্দুল আযিয (রঃ) এই মতে গ্রহন করেছেন
  • শাফিয়িদের মতে – প্রত্যেক সাহু সেজদা সালামের পূর্বে করতে হবে । ইমাম মাকহুল , ইমাম জুহরী , ইমাম আওযায়ী , এবং ইমাম লায়েছ (রঃ) এই মতকে গ্রহন করেছেন
  • মালিকিদের মতে – নামাজে ভুলে কিছু বৃদ্ধি করলে সালামের পরে আর কমতি করলে নামাজের পূর্বে সাহু সেজদা করবে । ইমাম আবু ছাওর , ইমাম মুযানী ও এক মত অনুসারে ইমাম শাফিয়ী (রঃ) ও এই অবস্থান গ্রহন করেছেন ।
  • হানবালিদের মতে – সেজদা সাহু বিষিয়ে হাদিসে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে করবে (অর্থাৎ যে কাজে রাসুল (সাঃ) আগে করেছেন তাতে আগে করবে আর যে কাজে পরে করেছেন তাতে পরে করবে ) । আর যদি এমন কিছু করে ফেলে যার বর্ণনা হাদিছে আসেনি তাহলে সালামের পূর্বে সাহু করবে ।

যাহিরি , ইমাম ইবনে হাজমের মতে – নিম্মক্ত দুই অবস্থা ব্যতিত প্রত্যেক সাহু সালাম ফিরানোর পর দিবে

  1. যখন কেউ দুই রাকাতের সময় তাহাজুদ্দের জন্য না বসে উঠে যায়
  2. যখন কারো সন্দেহ হয় যে সে তিন রাকআত আদায় করেছে না চার রাকআত

কিছু কিছু আলেমগণ বলেন এই বিষয়ে ভুলকারীর ইখতিয়ার রয়েছে অর্থাৎ সে চাইলে আগে করতে পারে চাইলে পরে করতে পারে

  • ইবনে হাজার রঃ – তিনি ইমাম আহমদের মতকে সকল মতের মধ্যে ন্যায়পরান বলেছেন
  • ইমাম নবাবী (রঃ) বলেন – ইমাম মালিকীর মত সবচেয়ে শক্তিশালী তারপর ইমাম শাফইয়ীর

**গ্রহণযোগ্য মত ** – উভয়ভাবেই জায়েয তবে উত্তম হচ্ছে হাদিছের যে বিষয়ের সাথে যেইভাবে সাহুর কথা আছে সেভাবে করা ।

  • ইমাম শাওকানী রঃ এই মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন ।
  • আব্দুর রাহমান মুবারাকপুরী (রঃ) ও এই মতকে এখতিয়ার করেছেন ।
  • সিদ্দিক হাসান খান (রঃ) বলেন – উভয়ভাবে জায়েয

যেই  হাদিসগুলোতে সালামের পূর্বে সাহুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে

  • আবূ সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ তার সালাতে সন্দেহে পতিত হয় এবং সে স্থির করতে ব্যর্খ হয় যে তিন রাকআত পড়েছে, তিন না চার রাকআত, তখন সে সন্দেহ পরিত্যাগ করবে এবং যে-কয় রাকআতের উপর দৃঢ় প্রত্যয় হয়, সেটিই ধারণ করবে। তারপর সালাম ফিরাবার পূর্বে দুটি সিজদা করবে যদি তার পাঁচ রাকআতই পড়া হয়ে গিয়ে থাকে, তবে এই দুই সিজদা মিলে ছয় রাকআত হয়ে যাবে। আর যদি তার সালাত পূর্ণ চার রাকআতই হয়, তবে দুই সিজদা! শয়তানের মুখে মাটি নিক্ষেপের শামিল হবে। (মুসলিম ১১৫৪)
  • আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ তোমাদের কারো সালাতের এক ও দু রাকআতের মধ্যে সন্দেহ হলে সে যেন তাকে এক রাকআত গণ্য করে। তার দু ও তিন রাকআতের মধ্যে সন্দেহ হলে সে যেন তাকে দু রাকআত গণ্র করে। আর তিন ও চার রাককআতের মধ্যে সন্দেহ হলে সে যেন তাকে তিন রাকআত গণ্য করে, তারপর অবশিষ্ট সালাত (নামায/নামাজ) পূর্ণ করে, যাতে সন্দেহটা অতিরিক্ত সালাতে হয়। অতঃপর সে যেন সালাম ফিরানোর পূর্বে, বসা অবস্থায় দুটি সিজদা করে।(ইবনে মাজাহ ১২০৯ হাসান)
  • আবদুল্লাহ্ ইবনু বুহায়নাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোন এক সালাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’রাক‘আত আদায় করে না বসে দাঁড়িয়ে গেলেন। মুসল্লীগণ তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন। যখন তাঁর সালাত সমাপ্ত করার সময় হলো এবং আমরা তাঁর সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করছিলাম, তখন তিনি সালাম ফিরানোর পূর্বে তাকবীর বলে বসে বসেই দু’টি সিজদা্ করলেন। অতঃপর সালাম ফিরালেন। (বুখারী ১২০৪)

যেই হাদিসগুলোতে সালামের পরে সাহুর উল্লেখ করা হয়েছে

  • ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’আসরের তিন রাক’আত সালাত আদায় করেই সালাম ফিরালেন এবং হুজরায় প্রবেশ করলেন। তখন লম্বা হাতওয়ালা বিশিষ্ট খিরবাক্ব নামক এক ব্যক্তি উঠে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! সালাত কি কমিয়ে দেয়া হয়েছে? এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত অবস্থায় চাদর টানতে টানতে বেরিয়ে এসে লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কি সত্য বলেছে? লোকজন বললো, হাঁ, তখন তিনি অবশিষ্ট এক রাক’আত সালাত আদায় করে সালাম ফিরালেন। অতঃপর দু’টি সাহু সিজদা্ দিয়ে পরে সালাম ফিরালেন । (মুসলিম ৫৭৪)
  • ‘আবদুল্লাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের সালাত পাঁচ রাক‘আত আদায় করলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, সালাত কি বৃদ্ধি করা হয়েছে? তিনি বললেন, এ প্রশ্ন কেন? (প্রশ্নকারী) বললেন, আপনি তো পাঁচ রাক‘আত সালাত আদায় করেছেন। অতএব তিনি সালাম ফিরানোর পর দু’টি সিজদা্ করলেন।(বুখারী ১১৫৩)
  • আবদুল্লাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন – তোমাদের কেউ সালাত সম্বন্ধে সন্দেহে পতিত হলে সে যেন নিঃসন্দেহ হবার চেষ্টা করে এবং সে অনুযায়ী সালাত পূর্ণ করে। অতঃপর যেন সালাম ফিরিয়ে দু’টি সিজদা দেয়। (বুখারী ৫৭১)
  • আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা আমাদের বিকালের এক সালাতে ইমামত করলেন। ইবনু সীরীন (রহ.) বলেনঃ আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) সালাতের নাম বলেছিলেন, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছে। আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) বলেনঃ তিনি আমাদের নিয়ে দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে সালাম ফিরালেন। অতঃপর মসজিদে রাখা এক টুকরা কাঠের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁকে রাগান্বিত মনে হচ্ছিল। তিনি তাঁর ডান হাত বাঁ হাতের উপর রেখে এক হাতের আঙুল অপর হাতের আঙুলের মধ্যে প্রবেশ করালেন। আর তাঁর ডান গাল বাম হাতের পিঠের উপর রাখলেন। যাঁদের তাড়া ছিল তাঁরা মসজিদের দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। সাহাবীগণ বললেনঃ সালাত কি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে? উপস্থিত লোকজনের মধ্যে আবূ বকর (রাযি.) এবং ‘উমার (রাযি.)-ও ছিলেন। কিন্তু তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেলেন। আর লোকজনের মধ্যে লম্বা হাত বিশিষ্ট এক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁকে ‘যুল-ইয়াদাইন’ বলা হতো, তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ভুলে গেছেন, নাকি সালাত সংক্ষেপ করা হয়েছে? তিনি বললেনঃ আমি ভুলিনি এবং সালাত সংক্ষেপও করা হয়নি। অতঃপর (অন্যদের) জিজ্ঞেস করলেনঃ যুল-ইয়াদাইনের কথা কি ঠিক? তাঁরা বললেনঃ হাঁ। অতঃপর তিনি এগিয়ে এলেন এবং সালাতের বাদপড়া অংশটুকু আদায় করলেন। অতঃপর সালাম ফিরালেন ও তাকবীর বললেন এবং স্বাভাবিকভাবে সিজদা’র মতো বা একটু দীর্ঘ সিজদা করলেন। অতঃপর তাকবীর বলে তাঁর মাথা উঠালেন। পরে পুনরায় তাকবীর বললেন এবং স্বাভাবিকভাবে সিজদা’র মত বা একটু দীর্ঘ সিজদা করলেন। অতঃপর তাকবীর বলে তাঁর মাথা উঠালেন। (বুখারী ৪০১)
  • সাওবান (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সালাতের যেকোন ভুলের জন্য সালাম ফিরানোর পর দু’টি সিজদা্ করতে হয় ।  (আবু দাউদ ১০৩৮ হাসান)