বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী জনগণের কাছে দাবি করছে যে তাদের পক্ষে ভোট দেওয়া মানে ইসলামের পক্ষে ভোট দেওয়া। তারা নিজেদের ইসলামিক মূল্যবোধ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু তাদের নেতারা ডেমোক্রেসির প্রশংসা করছেন, যা এমন একটি ব্যবস্থা যা ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে পুরোপুরি বিরোধী। তাদের সেক্যুলার মতবাদকে ইসলামিক ভাষায় মোড়ানো হচ্ছে, এবং দুঃখজনকভাবে অনেক মানুষই এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এটি অত্যন্ত জরুরি যে মানুষকে বোঝানো উচিত, ইসলাম ডেমোক্রেসি বা অন্য কোনো মানবসৃষ্ট শাসনব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং একটি প্রকৃত ইসলামিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এভাবে, যেখানে আল্লাহর আইনই প্রধান এবং মানুষের ভোট বা মতামত নয়। ইসলামকে রাজনৈতিক ism গুলোর সাথে মিশিয়ে ফেলা উচিত নয়, এবং একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসন ব্যবস্থা কীভাবে হওয়া উচিত, তা নিয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
“ইসলামি” রাজনৈতিক দলগুলো যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তা আমরা মানতেই চাই না। গত এক শতাব্দী ধরে আমরা দেখে আসছি জামাতে ইসলামীর মত বিভিন্ন দল ইসলামের নামে উঠে আসছে- মুসলিম ব্রাদারহুড, আন-নাহদা সহ অনেকেই। সবাই বলেছে, “আমরা শরিয়া ফিরিয়ে আনব”, “আমরা খেলাফত কায়েম করব”, “আমরা উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করব”। কিন্তু বাস্তবতা কী? কেউই পারেনি। কারও কেউ ক্ষমতায় গিয়েছে, কিন্তু কিছুই বদলাতে পারেনি। কেউ ক্ষমতা পেলেও টিকে থাকতে পারেনি। আর অনেকেই ইসলামের নামটা শুধু পোস্টারে রেখে নিজেরাই সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছে। প্রশ্ন একটাই: কেন? কারণ তারা ভুল খেলায় অংশ নিয়েছে। ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম করা যায় না এমন এক সিস্টেমের ভেতর ঢুকে যার মূল ভিত্তিই আল্লাহর বদলে মানুষের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। ডেমোক্রেসি বলে, “ক্ষমতার উৎস জনগণ।” ইসলাম বলে, “ক্ষমতার উৎস একমাত্র আল্লাহ।”
যখন আপনি এমন সংবিধান মেনে নিচ্ছেন যেখানে সুদ বৈধ, সেক্যুলার শিক্ষা বাধ্যতামূলক, আর আল্লাহর আইন নেই—তখন আপনি শুরুতেই ভুল পথে হাঁটছেন। তারা আদর্শ ছেড়ে ক্ষমতা চায়। শুরুতে অনেক দলের উদ্দেশ্য হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে গিয়েই তারা গোঁজামিল দিতে শুরু করে। ভোট পেতে হলে “মডারেট” হতে হবে—এই চিন্তায় তারা ইসলামের স্পষ্ট বিষয়গুলো আড়াল করে ফেলে।ধীরে ধীরে তারা সেক্যুলার দলগুলোর মতোই হয়ে যায়। নাম ইসলামী, কিন্তু কাজ সিস্টেমের মতোই।
তারা মানুষকে গড়ে তোলার কাজ বাদ দিয়েছে । নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় ১৩ বছর শুধু একটা কাজ করেছেন, মানুষ গড়ে তোলা। তাওহীদ শেখানো, শিরক দূর করা, ঈমানদার বানানো। তখনো কোনো রাষ্ট্র ছিল না। তাঁর মিশন শুরু হয়েছিল মানুষের অন্তর বদলানো দিয়ে, ব্যালট বাক্স দিয়ে নয়। আজ যদি আপনি এমন একটা জনগণের ওপর ইসলামী শাসন চাপাতে চান, যারা নিজেরাই জানে না কীভাবে ইসলামী জীবনযাপন করতে হয়—তাহলে সেই সমাজে খেলাফত বাস্তবে কায়েম হবে না, হবে শুধু নামে।
ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে উদাহরণ রেখেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলো, কিন্তু সেক্যুলার আইন ঠিকই রাখলো। মাত্র এক বছরের মাথায় সামরিক বাহিনী উৎখাত করল। আন-নাহদা তিউনিশিয়ায় ভোট পাওয়ার জন্য ইসলামী দাবিগুলো বাদ দিয়ে সেক্যুলার রূপ নিল।পাস (PAS) মালয়েশিয়ায় সেক্যুলার দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে নিজের পরিচয়ই মুছে ফেললো। AKP তুরস্কে ইসলামী বুলি দিয়ে শুরু করলো, এখন ইসলামী আলেমদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
তাহলে আসল পথ কী?
১. ঈমানকে ভিত্তি বানান, ব্যালট নয়। আল্লাহর আইন ফিরাতে হলে আগে আল্লাহকে মানুষদের জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাওহীদ শেখান। শিরক দূর করুন। মানুষকে শরিয়া বুঝতে ও মানতে তৈরি করুন। বিদআত বন্ধ করুন।
২. নিচের স্তর থেকে পরিবর্তন শুরু করুন। ইসলামী স্কুল, মসজিদ, মিডিয়া, ব্যবসা এগুলো গড়ে তুলুন। সিস্টেমের উপরে না, তার বাইরেও একটা শক্তিশালী মুসলিম সমাজ তৈরি করুন।
৩. ক্ষমতার পিছনে ছোটা বন্ধ করুন। নবী (সা.)-কে কুরাইশ বলেছিল: “আমরা তোমাকে শাসন ক্ষমতা দেবো”—তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন, “সূর্য ডান হাতে, চাঁদ বাম হাতেও দিলেও আমি এই দাওয়াহ ছাড়ব না।”
৪. শাসকদের নসিহত করুন, ফিতনা সৃষ্টি নয় ইসলামে প্রতিবাদ আছে, কিন্তু ফিতনা নেই। পরিবর্তন করতে চাইলে হিকমাহ দিয়ে করতে হবে। সশস্ত্র বিপ্লব বা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং অন্তর থেকে সমাজ বদলানো দরকার।
ইসলামী দলগুলো বারবার ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তারা আল্লাহর শাসনের বদলে মানুষের ভোটের ওপর ভরসা করেছে,আদর্শ ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতা অর্জনকে মুখ্য করেছে, আর নবীজির দেখানো আসল পথ তাযকিয়া ও দাওয়াহকে পাশ কাটিয়ে গেছে। সমাধান একটাই:কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়া। আত্মশুদ্ধি ও সমাজ গঠনের মাধ্যমে ভিত মজবুত করা।
ইমাম মালিক (রহ.) বলেছিলেন:
“এই উম্মতের শেষাংশ শুধুমাত্র সেই জিনিস দিয়েই সংশোধন হবে, যেটা দিয়ে শুরুটা হয়েছিল।”
ব্যালট বক্স দিয়ে নয়, ঈমান ও ইসলামিক অনুশাসনের অনুসরণের মাধ্যমেই আসে বিজয়।